জাগুয়ার, লেপার্ড, চিতা - এদের মধ্যে পার্থক্য কী?

জাগুয়ার, লেপার্ড, চিতা এর শরীরের উপরে প্রায় একই বর্ণের ও প্রায় একই ধরণের ছোপ ছোপ দাগের দিকে দৃষ্টিপাত করে আমরা এদেরকে একই প্রাণী বলে ভুল করে থাকি। কিন্তু বাস্তবে এই তিনটি প্রাণীই তিনটি আলাদা প্রজাতি। নিঃসন্দেহে প্রজাতি তিনটির মধ্যে ব্যাপক পরিমানে সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন, শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী প্রজাতি তিনটি একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, গায়ের রং-এ হলুদ-সাদা-কালো এর মিশালী প্রকট, তিনটি প্রজাতিই শিকারী প্রাণী, ইত্যাদি।

Difference Between Jaguar, Leopard, Cheetah

কিন্তু একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে আমরা এদের মধ্যকার পার্থক্য সমূহ নিরুপন করতে সক্ষম হব।

উপরে প্রদর্শিত চিত্রে প্রাণী তিনটির গায়ের ছোপ (Rosette) এর মধ্যকার অন্যন্য নকশা ভালোভাবে খেয়াল করুন।

প্রজাতি তিনটি একই পরিবারের হলেও উপ-পরিবার ভিন্ন। যেমন জাগুয়ার (Jaguar) ও লেপার্ড (Leopard) হলো Pantherinae (পান্থেরিনাই) এবং অন্যদিকে চিতা (Cheetah) হলো Felinae (ফেলিনাই) উপ-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আর তাই জাগুয়ার আর লেপার্ড এর মধ্যকার সাদৃশ্য চিতা অপেক্ষা বেশি। আর তাই জাগুয়ার ও লেপার্ডের মধ্যে বাঘ-সুলভ আচরণ বেশি পরিলক্ষিত হয়, অপরদিকে চিতার মধ্যে বিড়াল-সুলভ আচরণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। 

আর মজার বিষয়টা এখানেই যে, জাগুয়ার ও লেপার্ড বাঘের ন্যায় গর্জন (Roar) করতে পারলেও চিতা কিন্তু গর্জন করতে পারে না।

জাগুয়ার মূলত আমেরিকা মহাদেশের প্রাণী। মহাদেশটির উত্তরে অবস্থিত মেক্সিকো থেকে একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত আর্জেন্টিনা অবধি এই প্রাণীর বিচরণস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর লেপার্ড দেখতে পাওয়া যায় আফ্রো-ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। কিন্তু চিতা দেখতে পাওয়া যায় কেবল আফ্রো-এশিয়া অঞ্চল জুড়ে। ইউরোপের প্রাকৃতিক পরিবেশে সাধারণত চিতা বা জাগুয়ার বিচরণ করে না।

বাসস্থানের কথা বলতে গেলে প্রাণী তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জীবাঞ্চলে বিচরণ করতে পছন্দ করে। জাগুয়ার মূলত দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টি-অরণ্যের প্রাণী তবে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি-অরণ্যের বাইরে ও বৃষ্টি অরণ্যের আশেপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও জাগুয়ারকে বিচরণ করতে দেখা যায়। জাগুয়ার গাছ চড়ায় ও সাঁতারে বেশ দক্ষ। 

আবার চিতা পছন্দ করে আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের তৃণভূমিতে (Savanna) বিচরণ করতে। এর পাশাপাশি আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও এদেরকে কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়। তবে তৃণভূমি হলো এদের শিকার ধরার আদর্শ জায়গা। তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি বিদ্যমান থাকায় অতি উচ্চ গতিতে শিকারকে ধাওয়া করতে এদের কোনো বেগ পেতে হয় না। 

অপরদিকে অন্য যেকোনো বাঘ প্রজাতির থেকে লেপার্ডের বিচরণস্থল সবচেয়ে বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পূর্বের রাশিয়ার তাইগা থেকে পশ্চিমে আফ্রিকার তৃণভূমি পর্যন্ত এদেরকে বিচরণ করতে দেখা যায়।

নির্দিষ্ট কিছু জাগুয়ার ও লেপার্ডের মধ্যে মেলানিজম (Melanism) পরিলক্ষিত হলেও, প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ করা কোনো চিতার মধ্যে এই বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। মূলত একই প্রজাতির নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীদেহে কালো রঙের অধিক উপস্থিতির ফলে ত্বক ও চুল কালো হওয়ার যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তাকে মেলানিজম বলা হয়ে থাকে। মেলানিস্টিক লেপার্ডদেরকে সাধারণত ব্ল্যাক-প্যান্থার নামে ডাকা হয় (তবে প্রজাতি একই)।

সুস্থ, সবল ও প্রাপ্তবয়স্ক একটি পুরুষ জাগুয়ারের ওজন ১৫৮ কিলোগ্রাম অবধি হতে পারে। আর লেপার্ডের ওজন ৩০-৯৭ কিলোগ্রাম এর মধ্যে হয়ে থাকে সাধারণত। অপদিকে চিতার ওজন হয়ে থাকে ২০-৬০ কিলোগ্রাম। 

তাই বলা যায়, লেপার্ড হলো আকারের দিক দিয়ে জাগুয়ার এবং চিতার মাঝামাঝি আকৃতির। তবে চিতা লেপার্ড অপেক্ষা বেশি লম্বা হয়ে থাকে। এই তিনটি প্রাণীর মধ্যে দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে চিতা সবচেয়ে চিকন। আর এই বৈশিষ্টে চিতা অন্য প্রাণী দুটি থেকে ভিন্ন। এর ফলে চিতা গতিতে অপরাজিত

লেপার্ড আর জাগুয়ার একাকী বিচরণ করতে পছন্দ করে; প্রজনন এর প্রয়োজন ব্যাতিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী জাগুয়ার কখনো সন্নিকটে আসে না বা কাছাকাছি অবস্থান করে না; এই একই বৈশিষ্ট লেপার্ডদের মাঝেও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু চিতা দলবেঁধে বিচরণ করে থাকে। একাকী শিকার তাড়া করে থাকলেও, চিতার প্রায়ই সঙ্গবদ্ধ হয়ে শিকারকে কাবু করে ফেলে।

লেপার্ডের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট হলো শিকার ধরার পর শিকার এর ঘাড় কামড়ে ধরে শিকার নিয়ে সরাসরি গাছে উঠে পড়া। এই বৈশিষ্ট কখনো কখনো জাগুয়ারের মাঝে পরিলক্ষিত হলেও চিতার মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। এই বৈশিষ্ট্যটি লেপার্ডের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী। 

আমরা সকলেই ইতোমধ্যে জানি যে, লেপার্ড একাকী বিচরণ করে আর একাকী শিকার ধরে থাকে। কিন্তু লেপার্ড যেসকল অঞ্চলে বসবাস করে সেসকল অঞ্চলে বাঘ-সিংহ-হায়েনার ন্যায় অন্যান্য শিকারী প্রাণীও বিচরণ করে থাকে। এর ফলে অন্যান্য শিকারী প্রাণী বিশেষত যেসকল প্রাণী গাছে চড়তে জানে না সে সকল শিকারী প্রাণীদের কবল থেকে লেপার্ডের কষ্টার্জিত শিকার রক্ষা পায় আর লেপার্ড একাকী পেটপুরে খেতে পায়।

লেপার্ড আর জাগুয়ার সাধারণত রাতে শিকার ধরে থাকে কিন্তু চিতা মূলত দিনের বেলায় শিকার করে থাকে।

চিতার মাথা অপেক্ষা লেপার্ডের মাথা বড় ও অধিক গোলাকার, আর লেপার্ডের মাথা অপেক্ষা জাগুয়ারের মাথা আরও বড় ও অধিক গোলাকার।

উপরের সবগুলো বিষয় বিবেচনা করে এতটুকু বলা যায় যে জাগুয়ার আর লেপার্ড সবচেয়ে কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ দুটি প্রাণী; আর তাই এই প্রাণী দুটির মধ্যে পার্থক্য নিরুপন করাটা বেশ কষ্ট সাধ্য। তবে চিতা সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাণী জাগুয়ার ও লেপার্ডের সাথে চিতার তুলনা করাটা উপযুক্ত বলে মনে হয় না আমার কাছে। কারণ চিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ এক্কেবারেই ভিন্ন।

আরো পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন