মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা কে ছিলেন?
মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কথা আমরা প্রায় প্রত্যেকেই শুনেছি। লাইব্রেরীর ১০-১৫ টাকা দামের কৌতুকের বইয়ের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মজার গল্পসমগ্র। কিন্তু এই মোল্লা নাসিরুদ্দিন আসলে কে ছিলেন।
মোল্লা নাসিরুদ্দিন ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্য সময়কার একজন সুফীবাদী মুসলিম দার্শনিক এবং সেট্যায়ারিস্ট (ব্যাঙ্গ রচয়িতা)। সুফিবাদী কেনো বলা হয় সেটা জানি না, সম্ভবত বিভিন্ন গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অধ্যাত্মিক সুফিবাদী চিন্তাধারার কারনে। উনার জন্ম আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রোয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে। জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন সেলজুক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তর খোরাসানে। তবে কোনো নির্দিষ্ট দেশ বলা যায়না উনার মাতৃভূমি হিসেবে। কারণ অনেকগুলো দেশ মোল্লা নাসির উদ্দিনকে নিজেদের লোক বলে দাবি করে। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, উজবেকিস্তান তাজাকিস্তান তো বটেই এমনকি চাইনিজ মুসলিমরাও উনাকে নিজেদের দাবী করে। সেখানে উনাকে "আফান্টি"(এফেন্দি!) বলে ডাকা হয়। উইঘুররা উনাকে তাদের সম্প্রদায়ের লোক মনে করে।
তুরস্কে মোল্লা নাসিরুদ্দিন সম্মানে হয়ে থাকে ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জা উৎসব’। জুলাইয়ের পাঁচ থেকে দশ তারিখের মাঝে তুরস্কের আকশেহিরে এই উৎসব হয়ে থাকে। এই আকশেহির শহরেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সমাধি অবস্থিত। তবে এই সমাধি কি সত্যিই হোজ্জার সমাধি কিনা সেটার বিচার আমি করতে পারব না।
অনেক প্রচলিত গল্পে দেখা যায় গোপাল ভাঁড় আর হোজ্জার কাহিনী শুধু নাম পালটে দুজনের নামেই প্রচার করা হচ্ছে। তাই আমাদের কাছে হোজ্জার সাথে গোপাল ভাঁড়কে একই ধরনের চরিত্র মনে হয়। দুজনের অনেক মিল থাকলেও সমস্যা হলো হোজ্জা কখনো কোনো রাজদরবারে ছিলেন কি না, বা কোনো রাজার পরামর্শক ছিলেন কি না তা নিয়ে কোনো জনশ্রুতি নেই। গোপাল ভাঁড়ের সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তির অনুযায়ী আমরা জানতে পারি এই নামে একজন লোক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার সভাসদ ছিলো।
গোপাল ভাড়ের বিরুদ্ধে অনেক প্রচলিত একটি অভিযোগ যে তিনিই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে গিয়ে বৃটিশদের সাথে হাত মেলানোর বুদ্ধি দেন। আবার এর পুরোপুরি বিপরীত আরেকটি প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী গোপাল অনেক চেষ্টা করেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বৃটিশদের সাথে হাত মেলানো থেকে বিরত রাখতে না পেরে মনোকষ্টে বাংলা থেকে চিরতরে আত্মগোপনে চলে যান। অথচ গোপাল ভাঁড় নামে আসলেই কেউ ছিলো কি না তা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।*
এখন হোজ্জার নামে প্রচলিত দুইটা গল্প বলি।
একবার হোজ্জা বাজার থেকে এক সের মাংস নিয়ে এলেন, তার স্ত্রীকে বললেন কাবাব বানিয়ে দিতে। স্ত্রী কাবাব বানিয়ে হোজ্জা ফিরে আসার আগেই খেয়ে নিলেন সব কয়টা! হোজ্জা ফিরে আসলে দোষ দিলেন বিড়ালের। হোজ্জাও কম যান না, বিড়ালকে ধরে নিয়ে দাঁড়িপাল্লায় দিলেন, মেপে দেখা গেলো বিড়ালের ওজনও এক সের। হোজ্জা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন এই যদি বিড়াল হয় তবে মাংস কোথায়? আর এটাই মাংস হয় তবে বিড়াল কোথায়?
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মজলিশে এক লোক তার বয়স জানতে চাইলেন। মোল্লা উত্তর দিলেন তার বয়স চল্লিশ। মজলিশে উপস্থিত কয়েকজন জানালেন, দশ বছর আগেও মোল্লা তার বয়স চল্লিশ বলেছিলেন। তাহলে এখনো তার বয়স চল্লিশ থাকে কী করে? মজলিশের গুঞ্জন শুনে মোল্লা উত্তর দিলেন, তিনি এককথার মানুষ, কয়েকদিন পর পর মতের পরিবর্তন তিনি করেন না।
হাস্যরসাত্মক আলাপেই মোল্লা নাসিরুদ্দীন বলে দিলেন, সত্য সময়ের সাথে বদলে যায়, একই কথা আজকে সত্য হলে কাল হয়তো মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। তাই সময়ের সাথে আমাদের বদলে যেতে হয়, এটাই আমাদের ভবিতব্য। (উনার এই উপদেশ আবার সব ক্ষেত্রে সত্য নয়)
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সাথে গোপাল ভাড় ছাড়াও "বীরবল" ও "তেনালী রামের"ও মিল পাওয়া যায়। এদের মধ্যে তেনালী রাম কিছুটা অপ্রচলিত আমাদের কাছে।
লেখাঃ Muhin Elahi

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন